• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

যানজটে বিপর্যস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা

  • প্রকাশিত ২৮ মার্চ ২০২৪

এম এ বাবর:

রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখাই চ্যালেঞ্জ। যদিও দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনো শৃঙ্খলাই নেই। তারপরও রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে বহু পদক্ষেপ নিয়ে বার-বার ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

এ দিকে পবিত্র রমজান মাসে রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা বিশেষ ব্যবস্থায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। পরিকল্পনা মাফিক বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ রাস্তায় বিশেষ টিম কাজ করছে। কিন্তু তারপরও যানজটের কবলে পরে হাজার মানুষ ঘরে গিয়ে ইফতার করতে পারছে না।

বিগত সময়ে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু যোগাযোগে নিরাপত্তা, যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা এবং সর্বোপরি ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সকলে প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এবার দেশের ট্রাফিক সিগনালিং সিস্টেমকে আনা হচ্ছে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) পদ্ধতিতে।

তবে এই উদ্যোগও ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশের পরিবহণ ব্যবস্থাকে অবশ্যই শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। এর জন্য যত কঠোর হওয়ার দরকার তত কঠোরই হতে হবে।

রাজধানী ঢাকা যানজটের শহর হিসেবে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও এগিয়ে আছে ঢাকা। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০২৩ এমন তথ্য প্রকাশ করেছে।

এ দিকে বিগত ১৫ বছরে ট্রাফিক লাইটের পেছনে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ১১৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। যার দুই শতাংশরও সুফল মিলেনি। এরপর ঢাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) চালিত সিগনালিং সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।

২০১৫ সালের ১৫ মে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল রাজধানীর কাকলী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে। কিন্তু চালুর পরেই তীব্র যানজটে পুরো ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে। তিন-চার দিনের মাথায় ব্যয়বহুল এই ব্যবস্থার পরিবর্তে পুলিশ সেই হাত ও বাঁশির ব্যবস্থায় ফিরে যায়।

স্মার্ট প্রযুক্তির আওতায় আসছে দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা। প্রথম পর্যায়ে রাজধানী ঢাকায় ইন্টারসেকশন ট্রায়াল বেসিসে এআই-এর (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন) মাধ্যমে পরিচালিত হবে ট্রাফিক ব্যবস্থা। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের জেলা শহরে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হাতের ইশারায় পরিচালিত ট্রাফিক পদ্ধতির চেয়ে খরচ কমবে প্রায় আড়াইগুণ। আর উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে এআই পদ্ধতিটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্ধতিটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন যখন একই সাথে চলবে তখন এআই কাজ করবে না। তাই দুই ধরনের যানবাহন আলাদা করতে হবে। এছাড়া জংশনে লোকাল ট্রাফিক থাকলে এআই পদ্ধতি কাজ করবে না।

তাদের দাবি, পথচারীদের জন্য পৃথক ভাবে জায়গা থাকতে হবে। নয়তো গ্রিন সিগন্যাল থাকার পরও মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। সুফল পেতে এসব বিষয়গুলো ভালো ব্যবস্থাপনায় আনার পরামর্শ তাদের।

ঢাকার ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশের পেছনে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৩ কোটি ৬৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। যা বছরে আসে প্রায় ১৬৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অথচ এই ট্রাফিক পদ্ধতিকে যদি ইন্টারসেকশন ট্রায়াল বেসিসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন (এআই)-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাহলে প্রতি মাসে খরচ হবে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। যা বছরে হিসাব করলে খরচ হবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

হাতের ইশারায় পরিচালিত ট্রাফিক পদ্ধতির চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ কম খরচে ট্রাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। কারণ এআই পদ্ধতি বসানো হলে এটি প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত সচল থাকে। এই পদ্ধতিতে গাড়ির গতিবিধি ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বেশি কার্যকর করা সম্ভব। সিগন্যাল ছাড়ার আগে বা পরে কতগুলো গাড়ি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছে তা এআই ক্যামেরায় ধরে পড়বে। লালবাতি জ্বলা অবস্থায় সাদা দাগ অতিক্রম করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রাফিক মামলা হবে। সাথে সাথে আইন ভঙ্গকারীর মোবাইলে জরিমানার মেসেজ চলে যাবে। এতে ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা কমে যাবে ৯৯ শতাংশ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন পদ্ধতিতে সিগন্যাল মেইনটেন্যান্স সরঞ্জাম, সিসি ক্যামেরা, ইমেজ ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা ও অন্য সরঞ্জামাদি দিয়ে সিস্টেমটি সাজানো হবে।

ডিএমপির তথ্য মতে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে রাজধানীজুড়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন তিন হাজার ৯০৩ জন পুলিশ। যাদের প্রত্যেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত। ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা কনস্টবল থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রতি মাসে গড় বেতন প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। প্রতি মাসের বেতনকে বছরে গড় করলে প্রায় ১৩ কোটি ৬৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয় ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশদের জন্য। তাদের এই বেতনকে বছরে হিসাব করলে ১৬৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় হয় ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা সব ডিএমপির।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, শহরে যথাযথ ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকলে কোনো ডিজিটাল উদ্যোগই কার্যকর হবে না। যত খুশি তত প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। কিন্তু ডিজিটাল সিস্টেম এখানে কাজ করবে না, অতীতেও করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সড়ক নেটওয়ার্ক সুশৃঙ্খল নয়। লেন বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই, মোটরচালিত যান ও পেশী-চালিত যান একই রাস্তায় চলাচল করে এবং যানবাহনের পরিমাণ রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এমন অবস্থায় কোনো প্রযুক্তিই কাজ করবে না।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য সর্বমোট প্রায় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা খরচ হবে। রাজধানীতে মোট ১১০টি ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে। এআই পদ্ধতিতে ভিডিও ক্যামেরা ও সেন্সর এবং গতি মিটারসহ আরও কিছু সরঞ্জাম বসানো হবে এটিতে। একটি সড়কের চারটি লেনের বিপরীতমুখী গাড়িগুলো ডানের টার্নগুলো বাদ দেয়া হবে। তখন শুধু বামে ও সামনের দিকেই চলবে। এটাকে বলা হয় দ্বিমুখী সিগন্যাল। তাছাড়া এতে পথচারীর জন্য সবুজ বাতি দিয়ে হাঁটার সুযোগ করে দেয়া যেতে হবে। সব খরচ মিলিয়ে পায় ১৫শ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

সূত্র থেকে জানা যায়, উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে এআই পদ্ধতিটি। তবে এই পদ্ধতির দীর্ঘস্থায়ীর জন্য ভালো তদারকি থাকতে হবে। এআইয়ের যন্ত্রপাতি যেন সব আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারে সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। অনেক স্থাপনা দেখভালের কারণে অকেজো হয়ে গেছে। প্রতিটা মোড়ে আইল্যান্ড থাকে যা পাড় হলে ডানে-বামে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে। তার সাথে জিওমেট্রি মোটিফিকেশন করতে হয়। সরাসরি শুধু সিগন্যাল বসালেই হবে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের (টিইসি) নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব খাদেম বলেন, ট্রাফিক সিগন্যালকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা ডিএসসিসির রয়েছে। অযান্ত্রিক যানবাহনের জন্য এআই সিগন্যাল কাজ করে না। তাই আগে এগুলোর একটি ব্যবস্থা করতে হবে। এআই পদ্ধতির ব্যবহার করা হবে ট্রাফিকে। এর মাধ্যমে অটো ডিটেকশন হবে। ট্রাফিক সামলাতে ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। তাদের ইচ্ছে মতো কাজ করে। ফলে ট্রাফিকের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। তাই এর বিকল্প হিসেবে এআই পদ্ধতি চালু করা হবে। নতুন সিস্টেম আসলে পুলিশের ওপর নির্ভর করতে হবে না।

তিনি আরও বলেন, এআই তার নিজের মতো কাজ করে যাবে। কিছু বিষয় যাচাই-বাছাই করে এটাকে নিয়ে কাজ শুরু হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে এআই পদ্ধতি ট্রাফিকে বসানো হবে। এআই চালু হলে কেউ সিগন্যাল না মানলে সাথে সাথে জরিমানা হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে চালকের মোবাইলে জরিমানার মেসেজ চলে যাবে। সবার সহযোগিতা থাকলে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। প্রথমত পরীক্ষামূলক দু-এক জায়গায় বসিয়ে দেখা হবে। তারপর সমস্ত ঢাকাতে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সিগন্যাল ট্রাফিকের সব সমাধান না। বিগত অনেক বছর ধরে প্রায় দুইশ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকার সিগন্যালগুলোকে সাজানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও তারা কার্যক্রমে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সর্বশেষ জাইকার অর্থায়নে ঢাকার এআই পদ্ধতিতে ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হয়। সবুজ বাতি কতক্ষণ জ্বলবে তার পরিমাণও করা হয়। তাও ঠিক মতো কাজ করেনি।

তিনি আরও বলেন, যখন একটি শহরের যানবাহন রাস্তার সক্ষমতার কম বা সমান থাকে তাহলে এই ধরনের সিগন্যাল কাজ করবে। বেশি থাকলে কখনো কাজ করবে না। ঢাকার অধিকাংশ রাস্তায় পিক আওয়ারে কয়েকগুণ বেশি গাড়ি চলে। এমনটা হলে কোনো ধরনের পদ্ধতি কাজ করবে না। তবে এগুলো বসানোর আগে বেশি করে যাচাই করে নিতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads